সোমবার, ০৬ মে ২০২৪, ০৯:০২ পূর্বাহ্ন
আর্ন্তজাতিক ডেস্ক :: ভারতের পার্লামেন্টে কোন কোন শব্দ ব্যবহার করা যাবে না, লোকসভার স্পিকার তার এক নতুন তালিকা প্রকাশ করার পর তা বিরোধীদের প্রবল তোপের মুখে পড়েছে।
এই তালিকায় জুমলাবাজি, কোভিড-স্প্রেডার, শিশু-বুদ্ধি বা স্নুপগেটের মতো শব্দ যেমন আছে- তেমনি দুর্নীতিগ্রস্ত, ভণ্ডামি, নাটকবাজি বা লজ্জিত-র মতো রোজকার কথাবার্তায় ব্যবহৃত অতি সাধারণ শব্দও রয়েছে।
কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী থেকে শুরু করে তৃণমূল ও অন্যান্য বিরোধী দলের নেতারা এই নির্দেশিকাকে কার্যত ‘গ্যাগ অর্ডার’ বলে বর্ণনা করেছেন।
তারা মনে করছেন নরেন্দ্র মোদি সরকারকে আক্রমণ করতে বিরোধীরা অহরহ যে শব্দগুলো ব্যবহার করে থাকেন বেছে বেছে সেগুলোকেই এখন ‘অসংসদীয়’ বলে বলা হচ্ছে।
আগামী সোমবার ১৮ জুলাই থেকে শুরু হচ্ছে ভারতীয় পার্লামেন্টের বর্ষাকালীন অধিবেশন। ঠিক তার আগে লোকসভার স্পিকার ওম বিড়লার কার্যালয় থেকে সংসদ সদস্যদের কাছে এমন একটি বুকলেট বা পুস্তিকা পাঠানো হয়েছে, যা বহু এমপি-কেই তাজ্জব করে দিয়েছে।
ওই পুস্তিকায় নানা শব্দের একটি তালিকা পেশ করে স্পিকার জানিয়েছেন- সদস্যরা যেন সভায় ওই শব্দগুলোর প্রয়োগ থেকে বিরত থাকেন, নইলে তা সংসদের কার্যবিবরণী থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া হবে।
‘স্পিকার কি ভাষাবিদ না কি?’
যে শব্দগুলোকে তিনি ‘আনপার্লামেন্টারি’ বা ‘অসংসদীয়’ বলে মনে করছেন, তার মধ্যে আছে তানাশাহি বা স্বৈরতন্ত্র, নৈরাজ্যবাদী, শকুনি, বিনাশ পুরুষ, খালিস্তানি, ‘খুন সে খেতি’ বা রক্ত দিয়ে চাষ- কিংবা নির্যাতিত, ভণ্ড, দুর্নীতিবাজ, বেইমান এরকম বহুলপ্রচলিত অনেক শব্দ।
এরপর কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী ‘নতুন ভারতের নতুন অভিধান’ এই শিরোনামে টুইট করেছেন : দৈনন্দিন আলোচনা ও বিতর্কে যে শব্দগুলো প্রধানমন্ত্রী মোদির সরকার পরিচালনাকে সঠিকভাবে বর্ণনা করে- সেগুলোই এখন থেকে আর উচ্চারণ করা যাবে না।
এনসিপি দলের নেতা ও এমপি মাজিদ মেমনও বলছেন, ‘মনে হচ্ছে সরকারকে সমালোচনা থেকে বাঁচাতেই এই পদক্ষেপ। যদি সরকার কোনও দুর্নীতি করে, সভায় আপনি তাদের দুর্নীতিবাজ বলতে পারবেন না।’
‘একটা শব্দর ব্যবহার শোভন কী শোভন নয়, সেটা তো ভাষাবিদ বা সাহিত্যিকরা বলবেন – স্পিকার কীভাবে সেটা ঠিক করতে পারেন?’
‘দেশে ধর্ষণ চলতে থাকবে, অথচ আপনি পার্লামেন্টে ধর্ষণ কথাটাই বলতে পারবেন না – এ তো হাস্যকর!’, মন্তব্য করেন মেমন।
তৃণমূল নেতা ডেরেক ও’ব্রায়েন এই পুস্তিকাকে ‘গ্যাগ অর্ডার’ বা মুখ বন্ধ রাখার নির্দেশ বলে বর্ণনা করে বলেছেন, তিনি গণতন্ত্রের স্বার্থে পার্লামেন্টে এই শব্দগুলো ব্যবহার করে যাবেন – পারলে তাকে সাসপেন্ড করা হোক।
‘মোদির মুখে আগে লাগাম পরান’
স্পিকারের দেওয়া তালিকার অন্তত চারটি শব্দ ব্যবহার করে এমপি মহুয়া মৈত্র টুইট করেছেন, ‘তার মানে কি বলতে চাওয়া হচ্ছে, একটি ‘অপদার্থ’ সরকার, যাদের ‘ভণ্ডামি’র জন্য ‘লজ্জিত’ বোধ করা উচিত- তারা দেশের সঙ্গে কীভাবে ‘বেইমানি করেছে’ সেটা আমি লোকসভায় দাঁড়িয়ে বলতে পারব না?’
তার দলেরই সতীর্থ এমপি ও অভিনেত্রী শতাব্দী রায়ও বিবিসিকে বলছিলেন, বিরোধীদের মুখ বন্ধ করতেই এই পদক্ষেপ বলে তার ধারণা।
শতাব্দী রায়ের কথায়, ‘‘বিজেপিকে বর্ণনা করতে যে শব্দগুলো বলা হয়, সেগুলোই যে ওরা আটকাতে চাইছে তা তো পরিষ্কার। আমরা সবাই জানি এই সরকারকে ‘দুর্নীতিবাজ’ বলা হয়, ‘জুমলাবাজি’ও নরেন্দ্র মোদীরই সিগনেচার স্টেটমেন্ট।”
“আর এত রাশি রাশি শব্দকে আনপার্লামেন্টারি বলে দিলে আমাদের তো সভায় গিয়ে ‘মাননীয় মহাশয় বা মহাশয়া, আপনাকে বিনীত প্রণাম জানাই’ এভাবে কথা বলা ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না।”
শব্দ নিয়ে এ ধরনের বিধিনিষেধ আমদানি করলে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী মোদি সবার আগে তার আওতায় পড়ে যাবেন বলেও মন্তব্য করছেন শতাব্দী রায়।
তিনি বিবিসিকে আরও বলছিলেন, ‘‘আমাদের প্রধানমন্ত্রী যে ভাষায় ও যে ভঙ্গীতে প্রায়ই বিরোধীদের সম্পর্কে কথা বলে থাকেন, তার আগে কোনও প্রধানমন্ত্রী কোনওদিন ওভাবে বলেননি। তার শব্দের প্রয়োগেই তো সবার আগে লাগাম পরানো দরকার!”
‘স্পিকার শব্দ নিয়ে স্পর্শকাতর’
লোকসভায় বিজেপির সদস্য ও সাবেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী দেবশ্রী চৌধুরী কিন্তু পাল্টা দাবি করছেন, পার্লামেন্টের বিতর্কে শব্দের মার্জিত ও শালীন প্রয়োগ নিশ্চিত করতেই স্পিকার এই নির্দেশ দিয়েছেন।
স্পিকারের দেওয়া তালিকার নির্দিষ্ট কোনও শব্দ নিয়ে মন্তব্য না-করলেও মিস চৌধুরী বিবিসিকে বলছিলেন, ‘আমাদের স্পিকার ওম বিড়লাজি শব্দের প্রয়োগ নিয়ে খুব খুঁতখুঁতে ও সংবেদনশীল। সংসদে খারাপ শব্দ ব্যবহার করা হলে তিনি খুবই ব্যথিত হন।’
‘যে সব শব্দ একজন সাংসদের মুখে শোভা পায় না, তিনি চান পার্লামেন্টে সেগুলোর যথাসম্ভব কম ব্যবহার করে গণতন্ত্রের মন্দিরকে নিষ্কলুষ ও পবিত্র রাখতে।’
দেবশ্রী চৌধুরী সেই সঙ্গেই মনে করেন, জনপ্রতিনিধিরা ভোটে জিতে আসার পর অনেক সময় ভুলে যান তাদের তখন রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে সার্বজনীন হতে হয় এবং মাঠে-ময়দানের রাজনীতিতে যে শব্দগুলো চলে সেগুলো পার্লামেন্টে ব্যবহার করা যায় না।
“এই জন্যই বিজেপির পক্ষ থেকেও একটা আবেদন ছিল এই ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার, স্পিকার নিজেও চাইছেন সদস্যরা সংযত ও মার্জিত ভাষা প্রয়োগ করুন – তাই তিনি তাতে সাড়া দিয়েছেন এবং আমরা একে স্বাগত জানাচ্ছি”, বলছিলেন মিস চৌধুরী।
তবে তারা যে এই ফরমানকে স্বাগত জানাচ্ছেন না, বরং আগামী সপ্তাহ থেকে পার্লামন্টে শব্দ নিয়েও বাগযুদ্ধ হতে যাচ্ছে- বিরোধী দলীয় এমপিরা তা ইতিমধ্যেই স্পষ্ট করে দিয়েছেন।
এদিকে অসংসদীয় শব্দের তালিকা নিয়ে তুমুল হইচই শুরু হওয়ার পর স্পিকার ওম বিড়লা বৃহস্পতিবার বিকেলে সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে ‘ড্যামেজ কন্ট্রোলে’র চেষ্টা চালিয়েছেন।
বিড়লা সেখানে দাবি করেন, তিনি সংসদে কোনও শব্দকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেননি- শুধু অতীতে যে শব্দগুলো পার্লামেন্টের কার্যবিবরষী থেকে ‘এক্সপাঞ্জড’ হয়েছে বা বাদ পড়েছে, সেগুলোর একটা তালিকাই শুধু সদস্যদের দিয়েছেন।